টঙ্গীর ভোটের রাজনীতিতে যেহেতু এই বস্তিবাসী একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়, সেই হেতু সব রাজনৈতিক নেতারাই তাদের অপরাধকে দেখেও না দেখার ভান করেন। টঙ্গীর রাজনীতিতে মিটিং-মিছিলে লোক সংগ্রহ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অস্ত্রবাজিসহ বিভিন্ন কাজে বস্তিবাসীরাই বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছে খুব প্রিয়। এসব বস্তির শতকরা ৮০ ভাগ লোকই কোনো না কোনো অবৈধ ব্যবসা ও অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত। প্রত্যেকটি বস্তিই অপরাধের স্বর্গরাজ্য। ভয়ংকর অপরাধীদের ভয়ে বস্তিগুলোতে পুলিশসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের লোকজন রাতের বেলায় ঢোকার সাহস করেন না। সরকার যায়, সরকার আসে, কিন্তু বস্তির অপকর্ম বন্ধ হয় না। বস্তিবাসীর অপকর্র্মের ফলে টঙ্গীর সুশীল সমাজ অনেক জায়গায় বিব্রত ও লজ্জাবোধ করেন। আশপাশের থানার লোকজন মনে করেন, বস্তিবাসীর মতোই নাকি টঙ্গীবাসী। তাই বস্তির লোকদের অপকর্মে টঙ্গীবাসীরা কলংকিত।
মাদকের ট্রানজিট পয়েন্ট
টঙ্গীর মতো বাংলাদেশের আর কোনো থানায় অমন প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনা হয় বলে টঙ্গীবাসীর জানা নেই। কারণ ভারত ও মিয়ানমার থেকে যত বড় বড় মাদকের চালান বাংলাদেশে ঢোকে তার বেশিরভাগই প্রথমে বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়ক ও নদীপথ হয়ে অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয় টঙ্গীর বিভিন্ন বস্তি। এখান থেকে পর্যায়ক্রমে মাদকদ্রব্য পাইকারি বিক্রি হয় ঢাকা, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। টঙ্গীতে পাইকারির পাশাপাশি খুচরা মাদকদ্রব্যও খুব কম মূল্যে পাওয়া যায়। ফলে ঢাকাসহ আশপাশের জেলা থেকে অনেকেই প্রতিদিন আসেন মাদক সেবনের জন্য টঙ্গীর বস্তিগুলোতে।
দেশের আলোচিত অপরাধীরা গ্রেফতার হয় টঙ্গীতে
দেশের বিভিন্ন এলাকায় বড় ধরনের হত্যাকা-, অপহরণ, ডাকাতিসহ সব ধরনের নাশকতার চাঞ্চল্যকর মামলার অনেক আসামিই বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হয়েছে টঙ্গী এলাকা থেকে। কারণ টঙ্গীর ২৩টি বস্তিজুড়ে দেশের আলোচিত অপরাধীদের নিরাপদ জোন তথা অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন সময় টঙ্গী থেকে গ্রেফতার হয়েছে দেশের আলোচিত লেডিকিলার চাঁদপুরের কুখ্যাত খুনি রসু খাঁ, জঙ্গি সংগঠন জেএমবি’র অন্যতম সদস্য সানি, নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলসহ অন্যতম আসামি, কেরানীগঞ্জের স্কুলছাত্র আলোচিত পরাগ অপহরণকারী, ময়মনসিংহ ভালুকার ফোর মার্ডারের প্রধান সন্দেহভাজন আসামি হাফিজুর রহমান তনুসহ দেশের অসংখ্য চাঞ্চল্যকর মামলার অপরাধী।
ভয়ংকর ২৩ বস্তি
টঙ্গী এরশাদনগর বাস্তুহারার বৈধ বস্তিটিসহ আরও ২২টি বস্তি রয়েছে। এগুলো হচ্ছে এরশাদনগর বাস্তুহারা বস্তি, নতুন বাজার এলাকায় ব্যাংকের মাঠ বস্তি আমতলী এলাকায় কেরানীরটেক রেলওয়ে বস্তি, মাছিমপুর এলাকায় জিন্নাতের পেছনের বস্তি, নিশাতনগর এলাকার পেছনের বস্তি, চুড়ি ফ্যাক্টরির বস্তি, তেঁতুলতলা বস্তি, সিপাইপাড়া বস্তি, নামা বাজার বস্তি, কলাবাগান বস্তি, মেডিকেলের পেছনের বস্তি, দেওড়া এলাকায় কড়ইতলা বস্তি, কাঁঠালদিয়া বস্তি, দক্ষিণ আউচপাড়া এলাকায় বালুর মাঠ বস্তি, বেক্সিমকোর পেছনের বস্তি, নোয়াগাঁও এলাকায় বাহার আলীরটেক বস্তি, রেলজংশন এলাকায় জিআরপি বস্তি, আরিচপুর এলাকায় বৌবাজার বস্তি, নেকারবাড়ি বস্তি, বেলতলা বস্তি, টঙ্গীবাজার এলাকায় গোহাটা বস্তি, সান্দারপাড়া বস্তি, হাজীর মাজার (হাজীপাড়া) বস্তি।
ভয়ংকর অপরাধীদের গবেষণাগার
বাস্তুহারার জায়গাটি ছিল পিডব্লিউডি বিভাগের। দেশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে ঢাকায় আসা নদীভাঙন কবলিত এলাকার ভিটেমাটিহারা মানুষদের আশ্রয়ের জন্য টঙ্গীর দত্তপাড়ায় ১৯৭৪ সালের ৪ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহৃদয়তায় ১০১ একর (৩ বিঘা) জমির ওপর ‘দত্তপাড়া পুনর্বাসন এলাকা’ হিসেবে এ বস্তির গোড়াপত্তন ঘটে। বর্তমানে এ বস্তিটিকে বলা যেতে পারে ভয়ংকর অপরাধীদের গবেষণাগার। বাস্তুহারা বস্তির আগের নাম ‘দত্তপাড়া পুনর্বাসন এলাকা’ হলেও স্থানীয়রা এলাকাটিকে মুজিবনগর হিসেবে বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মৌখিকভাবে নামকরণ করেন জিয়া কলোনি, পরে ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকার বস্তিটির নামকরণ করেন এরশাদনগর, বর্তমানে ‘এরশাদনগর বাস্তুহারা’ নামে পরিচিত। প্রায় ৮৫ হাজার লোক বসবাস করেন এ বস্তিতে। এর মধ্যে ভোটার রয়েছেন প্রায় ২৯ হাজার। নামকরণের উলট-পালট হয়েছে মূলত রাজনৈতিক প্রভাবে। টঙ্গীর রাজনীতির পদপরিবর্তনে এই বস্তিটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। টঙ্গীর রাজনীতিতে এখানকার ভোটার ও সন্ত্রাসীরা একটি বিরাট ভূমিকা রাখে। তাই স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় বহু নেতার আগমন ঘটে এ বস্তিতে।
Leave a Reply