গ্রেফতার,গুপ্তহত্যা ও গুম আতঙ্কে বাংলাদেশর মানুষ।
জসিম মাহমুদঃআসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মানুষের মধ্যে নতুন করে শুরু হয়েছে গুপ্তহত্যা ও গুম আতঙ্ক। মনোনয়নপ্রত্যাশী এক বিএনপি নেতার লাশ উদ্ধারের পর অনেকেই এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এর সাথে গ্রেফতার আতঙ্কতো আছেই।
বিএনপি নেতা সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলন গ্রেফতারের আগে পুলিশের সাথে মোবাইল ফোন কথোপকথনেও নানা আশঙ্কার কথা বলেন। একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীদের অনেকেই এখন গুম ও গুপ্তহত্যার আশঙ্কায় রয়েছেন।
ঢাকায় দলীয় মনোনয়ন নিতে এসে কেবশপুরের বিএনপি নেতা আবু বকর সিদ্দিক (৬৫) গত ১৮ নভেম্বর নিখোঁজ হন। পরদিন ১৯ নভেম্বর তার লাশ উদ্ধার হয় বুড়িগঙ্গা নদী থেকে। আবু বকর সিদ্দিক যশোর-৬ সংসদীয় আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন নিতে ঢাকায় এসেছিলেন। ১৮ নভেম্বর রাতে তিনি তার ভাতিজা সুমনকে ফোন করে জানান, ‘তাকে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিরা অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। তাকে সম্ভবত রমনা পার্ক এলাকায় নেয়া হচ্ছে এবং টাকা না দিলে হত্যা করা হতে পারে। অপহরণকারীদের দাবি মোতাবেক পরিবারের সদস্যরা একটি বিকাশ নম্বরে দেড় লাখ টাকা দেন। পরে তারা আরো ৫০ হাজার টাকা দাবি করলে ২০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। কিন্তু দুই দফায় এক লাখ ৭০ হাজার টাকা বিকাশ করার পরও অপহরণকারী তাকে ছাড়েনি।
এই হত্যার পরে অনেকের মধ্যেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীরা এখন চরম আতঙ্কে ভুগছেন। অনেক নেতাকর্মী রয়েছেন যাদেরকে গ্রেফতারের পর নিয়ম অনুযায়ী আদালতে হাজির করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজধানীর পাশের আশুলিয়া, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও বুড়িগঙ্গা নদী থেকে প্রায়ই উদ্ধার হচ্ছে অজ্ঞাত লাশ। এর কোনো কোনোটির পরিচয় মিলছে; কোনো কোনোটি অজ্ঞাত হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, এগুলো এখন কিলিং জোনে পরিণত হয়েছে। গত সপ্তাহে আশুলিয়া থেকে এক ব্যক্তির মস্তকবিহীন লাশের সাতটি টুকরা উদ্ধার করা হয়। পরে তার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি যশোরের বাঘারপাড়ার অন্তরামপুর গ্রামের আবু বক্কর সিদ্দিকীর ছেলে। ৯ নভেম্বর বিকেলে বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন তিনি।
২৫ অক্টোবর সকালে নারায়ণগঞ্জের জালকুড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে লাশের অংশবিশেষ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশের টুকরোগুলো দেখে বুঝার উপায় নেই কিভাবে তিনি নিহত হয়েছেন। তবে পুলিশের দাবি ওই ব্যক্তি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ২১ অক্টোবর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের আড়াইহাজারে পাঁচরুখী ঘিদিরপাড়া এলাকা থেকে চার ব্যক্তি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তারা হলেন, লুৎফর রহমান মোল্লা, ফারুক, জহিরুল ইসলাম ও সবুজ সরদার। তাদের মধ্যে তিনজনের মাথায় গুলির চিহ্ন ছিল। একজনকে মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে লুৎফর রহমান মোল্লার বাড়ি ফরিদপুরে। বাকিরা পাবনার আতাইকুলার বাসিন্দা। ডিবি পরিচয়ে তাদের তুলে নেয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে পরিবারের পক্ষ থেকে। রূপগঞ্জের ভুলতা ফাঁড়িতে ফারুকের স্ত্রী তাসলিমার লাশ পাওয়ার আগের দিন রাতে স্বামীকে খাবারও দিয়ে এসেছিলেন বলে অভিযোগ করেন। ফারুকের স্ত্রী তাসলিমা বেগম অভিযোগ করেন, ১৯ অক্টোবর তার স্বামীকে তুলে নেয়া হয়েছিলো। ওই চারজনের লাশ পাওয়ার আগের দিন ২০ অক্টোবর ঢাকা বাইপাস সড়কের টেংরারটেক এলাকায় লাশ পাওয়া যায় আবুল হোসেন নামে আরেক যুবকের। আবুল হোসেন এবং তার ভাই কালামকে একই দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে। আবুলের বাড়ি সোনারগাঁওয়ের পঞ্চবটিতে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পুরিন্দা বাজারে থাকতেন তিনি। কালামের এখনো কোনো হদিস মিলেনি বলে জানা গেছে।
২০ অক্টোবর রাতে রাজধানীর তুরাগ থানার উত্তরার ১৬ নম্বর সেক্টরে একটি ঝোপ থেকে দুই যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। দুর্গন্ধ পেয়ে স্থানীয়রা ঝোপের ভেতরে লাশ দু’টি দেখতে পান। প্রথমে লাশ দু’টি অজ্ঞাত ছিল। পরদিন জানা যায় তাদের নাম কামাল ও ইমন। তাদের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে। পুলিশের বক্তব্য- তারা দুর্বৃত্ত। তাদের নামে অনেক অভিযোগ রয়েছে। হয়তো ডাকাতির মালামালের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে এই খুনের ঘটনা ঘটেছে।
সেপ্টেম্বর মাসে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকা থেকে তিন যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহতরা হলেনÑ রাজধানীর মহাখালী এলাকার শহীদুল্লাহর ছেলে মো: সোহাগ (৩২), মুগদা এলাকার মো: আব্দুল মান্নানের ছেলে শিমুল (৩১) ও ওই এলাকার আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার ছেলে নুর হোসেন বাবু (৩০)। পরিবারের অভিযোগÑ যাত্রীবাহী বাস থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্য পরিচয়ে কে বা কারা তাদের তুলে নিয়ে যায়। পরে তাদের লাশ পাওয়া যায়।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর বুড়িগঙ্গা নদী থেকে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির গলিত লাশ উদ্ধার হয়েছে। একই দিন কেরানীগঞ্জের তরিকুল্লাহর ডকইয়ার্ড সংলগ্ন বেড়িবাঁধ থেকে আরেক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। এই লাশগুলোর কোনো কিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
যশোরের দু’টি থানা থেকে ফারুক হোসেন (৫০) ও আজিজুল হক (৪৫) নামে দুই ভাইয়ের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হয়। তাদেরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে কে বা কারা নিয়ে যায়। পরে যশোরের শার্শা ও কেশবপুর থেকে দুই ভাইয়ের লাশ উদ্ধার হয়।
নিহতদের কোনো কোনোটির ব্যাপারে পুলিশের দাবি তারা সন্ত্রাসী ছিল। কোন্দলে তারা নিহত হয়েছে। কিন্তু কাদের সাথে এ কোন্দল তা জানাতে পারছে না পুলিশ। ওইসব হত্যায় যে প্রতিপক্ষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের কেউ গ্রেফতারও হয়নি।
Leave a Reply