১৪ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ।৩০শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ।সোমবার

সিলেটে পাসপোর্টের মার্কা বাণিজ্যে জিম্মি লাখো মানুষ।

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

এম এ রশীদ সিলেট থেকে।

 

প্রতিদিন ‘মার্কা’ দেয়া অন্তত সাড়ে চারশ ফাইল প্রতি গড়ে ১৫০০ টাকা করে আদায় করা হয়। সে হিসেবে মাসে হচ্ছে প্রায় দেড় কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন। আর এই মার্কা বাণিজ্যের সমন্বয়ক হিসেবে সামনে আসে একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম।

সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে দুর্নীতির খবর নতুন নয়। কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতা আর দুর্নীতির কাছে একরকম জিম্মি হয়ে আছেন এ অঞ্চলের লাখো সেবা প্রত্যাশী। তবে কোনো কিছুতেই লাগাম টানা যাচ্ছে না এই দুর্নীতির। বরং দুর্নীতিকে এক প্রকার শৈল্পিক রূপ দিয়েছেন দুর্নীতিবাজ কর্তারা।

 

বিয়ানীবাজারের বাসিন্দা মো. আমিনুর রহমান। বয়স উনিশ হলেও পান নি জাতীয় পরিচয়পত্র। জন্ম নিবন্ধন আর স্থানীয় চেয়ারম্যানের নাগরিকত্ব সনদ দিয়ে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন গত আগস্টে। তবে প্রথমেই জাতীয় পরিচয়পত্র লাগবে বলে আবেদন ফিরিয়ে দেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এরপর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ফের আবেদন করেন জাতীয় পরিচয়পত্রের কম্পিউটার কপিসহ। এবারো ফলাফল একই। বলে দেয়া হয় অভিভাবকসহ এসে জমা দিতে হবে। দুদিন পর অভিভাবকসহ আবারো পাসপোর্ট অফিসে আসেন। তবে এবারো ব্যর্থ হন আবেদন জমা দিতে। এবারের কারণ, চালান জমা দেয়ার দুই মাস হয়ে গেছে, ফের চালান জমা দিতে হবে।

 

আমিনুর রহমান বলেন, ‘আমার পাসপোর্ট না হবার একমাত্র কারণ হলো আমি মার্কা কিনি নি। পাসপোর্ট আবেদন জমা দিতে হলে আগে মার্কা কিনতে হয়।’

 

আমিনুর রহমানের মতো এমন ভুক্তভোগীর সংখ্যা অগণিত। বিশেষ কেউ নয়, ছাত্র হোক কিংবা পেশাজীবি, বেকার হোক কিংবা প্রবাসি শ্রমিক মার্কা ছাড়া গেলেই বিপদ আর হয়রানি। এমন বেশ কিছু অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নামে সিলেট বিভাগীয় ব্যুরো অনুসন্ধানে দেখা যায় সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের ‘মার্কা’ বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। পাসপোর্টের জন্য জমা দেয়া ৯০ শতাংশ ফাইলেই রয়েছে নির্দিষ্ট গোপন ‘মার্কা’। প্রতিদিন ‘মার্কা’ দেয়া অন্তত সাড়ে চারশ ফাইল প্রতি গড়ে ১৫০০ টাকা করে আদায় করা হয়। সে হিসেবে মাসে হচ্ছে প্রায় দেড় কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন। আর এই মার্কা বাণিজ্যের সমন্বয়ক হিসেবে সামনে আসে একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম।

 

সিলেট বিভাগীয় ব্যুরো প্রধান পক্ষকালব্যাপী অনুসন্ধানে মার্কা বাণিজ্যের সত্যতা পাওয়ার এক পর্যায়ে দুর্নীতির প্রমাণ রাখতে মোরশেদা আক্তার নামের এক পাসপোর্ট প্রত্যাশীর সাথে আলাপ করে তাকে দিয়ে পাসপোর্ট আবেদন জমা দিতে দেয়া হয়। যথারীতি আবেদন ফেরত আসে, স্থায়ী ঠিকানায় উল্লেখিত জেলায় গিয়ে জমা দিতে বলা হয়। তবে ভুগতে হয় নি খুব। লাইনের পাশেরই এক ভদ্রলোক এসে জানতে চান কি সমস্যা? সমস্যার কথা বললে অনেকটা ধমকের সুরেই বলে ওঠেন “আপনারা শিক্ষিত মানুষ হয়ে এসব কাজ নিজে নিজে করতে যান কেনো? জানেন না মার্কা ছাড়া আবেদন জমা নেবে না?”। ভদ্রলোকের কাছে জানতে চাওয়া হয় মার্কার ব্যাপারে।

 

তিনি জানান, প্রতিটি আবেদনের কোন এক জায়গায় একটি বিশেষ চিহ্ন দেয়া থাকে দালালদের। সেটা হতে পারে কোনো ট্রাভেল এজেন্ট কিংবা কোনো ফটোকপির দোকান বা ব্যক্তিবিশেষ। মার্কার দাম হিসেবে পাঁচ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট হলে দেড় হাজার আর দশ বছর মেয়াদি পাসপোর্টের জন্য আড়াই হাজার টাকা।

 

পাঁচ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট করতে হবে জানিয়ে তাকে দেড় হাজার টাকা দিলে সে পরদিন আসতে বলে। পরদিন এসে তার কাছ থেকে আবেদন নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা যায় আগের কম্পিউটারাইজড আবেদন পত্রে শুধু হাতে লেখা একটি অসম্পূর্ণ ইমেইল এড্রেস লিখা রয়েছে। এবার লাইনে দাঁড়ানো হলো। তবে এবার আর কিছুই দেখা হলো না, এক পাতা উল্টে মার্কা দেখেই আবেদন গৃহীত হলো। একই লাইনে আগেরদিন যাদের বিভিন্ন কারণে ফেরত দেয়া হয়েছিল তাদেরও সবারই একই ভাষ্য। মার্কা নিয়ে গেলেই কোনো কথা ছাড়াই জমা নেয়া হচ্ছে। আর মার্কা নেই আপনি যেই হোন না কেন, আবেদন জমা হবে না।

 

 

 

অনুসন্ধানে জানা যায়, পাসপোর্ট অফিসে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে দুর্নীতি চলে আসলেও মার্কা বাণিজ্য শুরু হয়েছে বিগত বছর দেড়েক থেকে। এমন বাস্তবতায় গত সপ্তাহে একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় মার্কা বাণিজ্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর সেই মার্কার ধরণ পাল্টে দেয় পাসপোর্ট অফিসের অসাধু কর্তারা। পরিবর্তিত মার্কার ধরণ এখন হাতে লেখা একটি অসম্পূর্ণ ইমেইল এড্রেস। ফাইলে এই ইমেইল এড্রেস দেখেই নির্দিষ্ট দালাল চিহ্নিত করেন অসাধু কর্মকর্তারা।

 

এসব মার্কা বিতরণে জড়িত আছেন অন্তত ২০টি ট্রাভেল এজেন্ট, ফটোকপির দোকান ও ব্যক্তি। বেশ কয়েকজন দালাল ও ট্রাভেল এজেন্টর সাথে আলাপ করে জানা যায়, মার্কা প্রথা চালু করে সবকিছু ম্যানেজ করেন সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের সুপারিন্ডেন্টেট এসএম জাকির হোসেন ও উচ্চমান সহকারী দীপক কুমার দাস। তবে তারাও সরাসরি যোগাযোগ না করে অফিসের ড্রাইভার, নাইটগার্ড ও আনসারদের মাধ্যমে টাকার লেনদেন করেন দালালদের সাথে।

 

বিষদ অনুসন্ধানে জানা গেছে- সারাদিন পাসপোর্টের ফাইল জমা গ্রহণের পর বিকেলে মার্কা চিহ্নিত ফাইলগুলো আলাদা করা হয়। এরপর নির্দিষ্ট মার্কা দেখে দেখে দালাল চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে ওইদিন বা তার পরের দিন দালালদের জানিয়ে দেয়া হয় তাদের ফাইলের সংখ্যা এবং টাকার অংক। যা বুধবারের আগেই অফিসের ড্রাইভার, নাইটগার্ড ও আনসারদের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের কাছে জমা হয়। এরপর বৃহস্পতিবার হয় টাকার ভাগ বাটোয়ারা।

 

এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে ট্রাভেল এজেন্টদের সংগঠন আটাব সিলেট অঞ্চলের সাবেক সহসভাপতি আব্দুল জব্বার জলিল বলেন, সিলেট পাসপোর্ট অফিসে দুর্নীতি আগেও ছিল, তবে গত দু তিন মাস থেকে এটি মহামারী আকার ধারণ করেছে। আগে অর্ধেক ফাইল দালালদের মাধ্যমে জমা হলেও অর্ধেক সরাসরি সেবাপ্রত্যাশীরা জমা করতে পারতেন। কিন্তু এখন শতভাগ পাসপোর্টই দালালদের মাধ্যমে করতে হয়। কেউ সরাসরি নিজে জমা দিতে চাইলে তাকে অন্তত পাঁচ দফা ঘুরানো হয়। এরপরেও যদি জমা নেন পাসপোর্ট পেতেও বিলম্ব হয়। আর তাই মানুষ বাধ্য হয়েই দালালের শরনাপন্ন হয়।

 

তবে এমন অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেন সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের সুপারিন্ডেন্টেট এসএম জাকির হোসেন।

এই পোস্টটি আপনার সামাজিক মিডিয়াতে সেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

রনজিৎ বর্মন শ্যামনগর(সাতক্ষীরা)প্রতিনিধি ঃ

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় নীলাকাশ টুডের সম্পাদক মোঃ নুরুজ্জামানের সড়ক দূর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে মৃত্যু হয়েছে।

শুক্রবার (২৬ জুলাই) রাত সাড়ে দশটায় শ্যামনগর উপজেলা সদরের নিকবর্তী গোপালপুর সড়কে কুলখালী নামক স্থানে দূর্ঘটনাটি ঘটে।

নিহতের পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় রাত সাড়ে দশটায় নিজ বাইসাইকেল যোগে নিজ বাড়ী উপজেলার নুরনগর ইউপির নুরনগর গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হন। এ সময় গোপালপুর মুক্তিযোদ্ধা সড়কে কুলখালী নামকস্থানে নির্মানাধীন বক্স কালভার্টের গর্তে সাইকেল সহ পড়ে যান। নির্মানাধীন বক্স কালভার্টের বাহিরে বের হওয়া লোহার রড তার মাথায় ছিদ্র হয়ে ঢুকে যেয়ে এক পাশ থেকে অপরপাশে বের হয়ে যায় পর স্থানীয়রা শ্যামনগর উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাঃ আনিছুর রহমান মৃত বলে ঘোষণা করেন।

শ্যামনগর প্রেসকাবের সাবেক সভাপতি আকবর কবীর বলেন কিছুদিন পূর্বে এই বক্স কালভার্ট তৈরী করতে যেয়ে একই সড়কে মোমিন মল্লিক নামে এক শ্রমিক মারা যান। তিনি আরও বলেন  নির্মানাধীন বক্স কালভার্টের  ঠিকাদার হিসাবে কাজ করছেন এস এম আবুল বাসার।

নীলাকাশ টুডের সম্পাদক মোঃ নুরুজ্জামানের মৃত্যুতে গভীর ভাবে শোক প্রকাশ করেছেন সাতক্ষীরা-৪ আসনের এমপি এস এম আতাউল হক দোলন, শ্যামনগর উপজেলা প্রেসকাবের আহবায়ক শেখ আফজালুর রহমান সহ সকল সাংবাদিকবৃন্দ, সুন্দরবন প্রেসকাবের সাংবাদিকবৃন্দ প্রমুখ।

ছবি- নিহত নীলাকাশ টুডের সম্পাদক মোঃ নুরুজ্জামান।

রনজিৎ বর্মন
তাং-২৭.৭.২৪

নীলাকাশ টুডের সম্পাদক নুরুজ্জামান সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত।